প্রতিমা ভেঙে ফেললে কি মনের ভেতরে যে প্রতিমা লুকিয়ে থাকে তা হারিয়ে যায় ?

স্মৃতিচারণঃ
প্রতিবছর দুর্গাপূজা আসলে মনে এবং শরীরে একটা অন্যরকম অনুভূতি জেগে উঠে। আমাদের বাড়ির সবচেয়ে কাছে যে মন্দিরটি তার আলোক সজ্জা আমাদের বাড়ি থেকে দেখা যেত। ঢাকের বাড়ি যেই শুরু হত মনের ভেতর সুরসুরি কবে ঠাকুর (প্রতিমা) দেখতে বের হব। তখনকার সময়ে বাটা থেকে লাইলন বা প্লাস্টিক সাদা জুতা পাওয়া যেত, সাথে ইংলিশ প্যান্ট(মানে হাফ প্যান্ট) আর একটা ফুলহাতা জামা ছিল প্রতি পূজোর নিদেনপক্ষে চাহিদা। পাশের মন্দিরটা খুব কাছে হওয়াতে প্রতিমা বানানো দেখা আমার জন্য নেশা ছিল। আমি প্রতিদিন স্কুল থেকে এসেই অন্তত একবার ছুটে যেতাম মন্দিরে। প্রথম দিকে খড় আর সুতা দিয়ে বিড়ে বানাতো (প্রাথমিক কাঠামো), এরপর কাঠ বাঁশের পাটাতনের উপর প্রতিমা বসানো হতো। এরপর শুরু হত মাটি আর পানি দিয়ে প্রতিনিয়ত পালিশ। আস্তে আস্তে তৈরি হয়ে যেত সুন্দর প্রতিমা। আমার সবচেয়ে আগ্রহ হত কিভাবে অসুরকে বানানো হচ্ছে, বাঘটা কতখানি হিংস্রমূর্তি ধারণ করছে। প্রতিমার হাতের আঙুল আর মাথা বসানো দেখার ইচ্ছা হত সবচেয়ে বেশি। আর শেষের দিকে পর্দা টানাঙো হতো রং করার সময়। অনেকটা এই রকম যে, পূজা শুরুর দিন সবাই একবারে পোশাক পড়ানো প্রতিমা দেখবে।

প্রতিমা বানানোর প্রতিটা ধাপ, যে পরম মমতা দিয়ে ভাস্করের তৈরি করে তা নিয়ে চিন্তা করতেই অন্য রকম একটা অনুভূতি আসে। এইযে আমি এখন প্রতিদিন অফিসে এসে যেমন এক মনে প্রোগ্রামিং বা কোডিং করি ওরাও সুচালো হাতে নিখুঁত ভাবে তৈরি করে। সেই সময় আমার কাজ ছিল মন্দির থেকে এসেই বাড়িতে বসে ছোট প্রতিমা বা রেপলিকা তৈরি করা। আমিও লেগে যেতাম খড়কুটো নিয়ে। মা মাঝে মাঝে রাগ করত কারণ অদ্ভুত ভাবে এই বাড়ি আগে যাদের ছিল সেই বাড়ির একটা ছেলে নাকি নিজে কালি প্রতিমা বানিয়ে পুজো করত আর একদিন সে আত্মহত্যা করে কি কারণে। তাই আমাকে প্রতিমা বানাতে দেখে মা ভয় পেত। যাই হোক, মার বকা খেয়েও আমি বানাতাম। প্রতিমার জন্য ছোট্ট একটা ঘর আর সেই ঘরের ভেতর আমিও মন্দিরের ভাস্করের মত প্রথমে খড় আর সুতো দিয়ে প্রাথমিক কাঠামো বা বেড়ি, তারপর পানি আর মাটি দিয়ে লেপতে থাকা। আমার সবচেয়ে বড় দূর্বলতা ছিল আমি কোন ভাবেই হাতের আঙুল আর মাথা বানাতে পারতাম না। আমার প্রতিটি প্রতিমার হাতের আঙুলগুলো অসম্ভব বড় হত (মানে রেশিও অনুসারে হত না) আর মাথা বানাতে পারলেও তার চোখ নাক কিছু বুঝা যেত না।

একদিন স্কুল থেকে এসে, দেখি আমার ছোট প্রতিমা আর মন্দির তচনচ। বাড়ির লোকজনের কাছে জিজ্ঞাসা করতে জানতে পারলাম দুইটা কুকুর মারামারি করতে গিয়ে আমার প্রতিমা ভেঙে ফেলেছে। আমি সেকি কান্না। এত কষ্ট পেয়েছিলাম। আজ হঠাৎ মনে পড়ে গেল। আচ্ছা বড় বড় প্রতিমাগুলো যখন কথিত দূর্বৃত্তরা ভেঙে দেয় তখন ঐ ভাস্কররেরা কি মনে অনেক কষ্ট পায় ? আর যে মানুষগুলো একটা বছর অপেক্ষা করে থাকে প্রতিমার মুখ দেখবে তারা যখন মন্দিরে গিয়ে দেখে প্রতিমার মাথা কেউ ভেঙে ফেলেছে তারা কি মনে কষ্ট পায় ? প্রতিমা ভেঙে ফেললে কি মনের ভেতরে যে প্রতিমা লুকিয়ে থাকে তা হারিয়ে যায় ?