কষ্টকর শ্রমের ক্যাটাগরীতে আমার চেনা জানার ভেতর মাটি কাটাকে আমার বেশ কষ্ট সাধ্য কাজ বলে মনে হয়। ছোট বেলায় আমার বাড়ির আশেপাশে কোন পুকুর কাটলে আমি গিয়ে প্রচন্ড আগ্রহ নিয়ে দাঁড়িয়ে দেখতাম। ছোটবেলায় যদিও আমার প্রচন্ড আগ্রহ নিয়ে দেখার মত অনেক কিছুই ছিল, বৈশাখ মেলার সময় বিশাল দেহী সার্কাসের হাতী, দূর্গা পূজার সময় মন্দির সামনে ঘন্টার পর ঘন্টা দাঁড়িয়ে পালদের প্রতিমা বানাতে দেখতাম। বাড়ি এসে আবার নিজেও কত বানানোর চেস্টা করেছি, খড়, লাঠি, দড়ি দিয়ে কাঠামো বানিয়ে গায়ে কাদামাটি দিয়ে লেপে লেপে অনেক বার প্রতিমা বানোর চেস্টা করেছি, কিন্তু সমস্যা হচ্ছে মুখ বানাতে পারতাম না, হাতের আঙুল গুলো হতো না, অনেক বার মাথা ছাড়াই নারী মূর্তি বানিয়ে অনেক বার। একবার স্কুল(তখন হাই স্কুলে পড়তাম) থেকে বাড়ি এসে দেখি আমার অনেক কষ্ট করে বানানো প্রতিমা আর তার জন্য পাটের খড়ি দিয়ে বানানো ছোট ঘরে ভেঙে তচনচ, মা বলেছিল দুইটা কুকুর নাকি মারামারি করতে গিয়ে ভেঙে ফেলেছে, আমি সেকি কান্না ! ধূর কোথা থেকে কোথায় চলে গেলাম, আবার মাটি কাটতে ফিরে এলাম। মাটি কাটা শ্রমিকেরা কাজ করে আধাবেলা, পুকুরের মালিকেরা তাচ্ছল্যের সাথে বলে, দেখ বাবা সূর্য মাথার উপর উঠলেই তারা কেটে পড়ে। কিন্তু মাটি কাটা আসলেই অনেক কঠিন কাজ, ভেজা মাটি কাটা কিংবা মাথায় তুলে বড় ঝুড়িতে কিছুদূর নিয়ে ফেলা অনেক কষ্টের, জমি থেকে ধানের বোঝা নিয়ে বাড়িতে ফেরাও মনে হয় এই রকম কষ্টের। আমি নিজেকে খুব সৌভাগ্য মনে করি আমি এমন সময় এবং জায়গায় জন্মেছি যখন আমি গ্রাম এবং শহরের(যদি ঢাকাতে শহর হিসাবে ধরে নেই) দুটোই দেখার সুযোগ পেয়েছি। ২০০৩ এর আগে পর্যন্ত ঢাকার আসার সুযোগ হয়নি। আবার বার সেই মাটি কাটা থেকে সরে গেলাম। যাই হোক, ছুটির দিনের অন্য বিকালের মত আজকের বিকাল এক নয়। শুক্র শনিবারের দিন গুলো সারা দিন শুয়ে কিংবা বই পড়ে কাটায় আজকেও তাই করেছি কিন্তু আজকের বিকালটা অন্য রকম। বিশেষ কোন ছুটির দিন গুলো কেন আমার ভীষন করম ছটফট লাগে, আজকে মে দিবস, কেন বার বার মাটিকাটা শ্রমিক এবং মাটিকাটা শ্রমের কথা বলছি তা বলছি এখুনি। প্রতিদিন শনি থেকে বৃহঃবার অফিসে সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত যে পরিমান পরিশ্রম করি তা মাটিকাটার থেকে কম নয়। নিজেকে একজন কীবোর্ড শ্রমিকও মনে হয়। সূর্য মাথার উপর উঠলেই যে আমার কাজ শেষ হয় না, আমার কাজ শেষ হয় সূর্য ডোবার, কাটাবনের নতুন অফিস শুরু করার পর এখন দিনের আলো থাকতে বের হই। বিকালে কিছুক্ষন ঘুরাঘুরি না করলে বাসায় ফিরে যেন চোখ অন্ধকার দেখি।
বুয়েটে হলে থাকার দিন গুলোতে বিকালে আমার একটা নেশা ছিল কম্পিউটার নিয়ে পড়ে থাকা, একদম শুরুর দিকে যখন কীবোর্ড মাউস চালাতে শিখতেছিলাম তখন আমার একটা শখের কাজ ছিল ভিডিও এডিট করে কোন পছন্দের গান জুড়ে দেওয়া। এই রকম বেশ কিছু মজার মিউজিক ভিডিও আমার বানানো ছিল, রুমমেট চন্দনদাকে দেখাতাম। বন্ধু সুজিত আমাকে প্রথম তার দিদির বাসা থেকে প্রথম একটা ডেক্সটপ কমপিউটার ছুয়ে দেখার সুযোগ করে দিয়েছিল। কিভাবে মিডিয়া প্লেয়ার গান চালাতে হয় দেখিয়ে দিল এক নিমিষে, আমি পরের পলকে ভুলে গেলাম। পরে হল জীবনে চন্দনদা শুরুতে কম্পিউটার বেসিক ব্যবহার শিখিয়ে দিয়েছিলেন, পরের টুকু আমি নিজে নিজেই শিখেছিলাম। হঠাৎ কেন এই বিকেলকে অন্য বিকালের মত মনে হচ্ছে না কিংবা কেন সেই ভিডিও এডিট এর কথা মনে পড়ে গেল তা মনে হয় এই মুহুর্তে যখন আমি লিখছি আমি বেশ কিছুদিন বাদে আবার আজকে জেসমসের গান শুনছি। আমার একটা মিউজিক ভিডিও ছিল জেসস এর গান নিয়ে। গানের কথার সাথে আমি খুঁজে খুঁজে এমন একটা ভিডিও লাগিয়েছিলাম(আমি ভিডিও কেটে কেটে জুড়াতাম তখন) যে আমি নিজেই অবাক হয়ে গেলাম আর তখন নতুন কম্পিউটার কিনেছি, ছোট বেলার মত অবাক এবং অকৃত্রিম আগ্রহ নিয়ে যন্ত্রটাকে নিয়ে খেলা করতাম। জেমসের কোন গানটা ব্যবহার করেছিলাম এ আমি কাউকে বলব না, কখনই বলব না 😛 আমার কাছে জেমস এর অনেক গান আছে, সচারাচর শোনা যায় এসব গান থেকে বেশ কিছু পুরাতন গান আছে। এখনকার পোলাপাইন যে ধরনের ব্যান্ডের গান শুনে আমার কৈশোর কিংবা যৌবনের শুরুতে ব্যান্ডের গানের ধরন আলাদা ছিল। আমরা জেসম, আয়ুব্বাচ্চু কিংবা হাসান কে ভালো গায় তা নিয়ে বন্ধুরা অনেক তর্ক করতাম। আমি তখন জেসস এর গান শুনেছি ক্যাসেটে, চেহারা জানতাম না, পোস্টারে দেখলে চিনতাম না। বন্ধুদের বলতাম ঐযে দ্বরাজ কন্ঠ, ভারী কন্ঠ যার তার গান ভালো লাগে।
আজকের দিনটা অন্য রকম। যখন লেখা শুরু করেছিলাম তখন আলো ছিল, আমার জানালা দিয়ে বাইরের নতুন বানানো বিল্ডিং দেখতে পাচ্ছিলাম, এখন অন্ধকার হয়ে গেছে। লিখতে লিখতে এই রকম দিন থেকে অন্ধকার এর পরিবর্তন আমি খুব খেয়াল করি। কিন্তু কেন যেন আমাকে ফাঁকি দিয়ে কখন হঠাৎ অন্ধকার নেমে গেল টের পেলাম না। ছোট বেলায় বিকালে খেলাধুলা করতে বাড়ি থেকে বাধা দিত না, কিন্তু কথা ছিল সন্ধ্যার আগে আগে ফিরে আসতে হবে। আমি মাঠে খেলতাম আর খেয়াল করতাম কখন অন্ধকার নামবে। হঠাৎ খেয়াল করতে অন্ধকার হয়ে গেছে চারিধার আর আমি সন্ধ্যা নামার পর বাড়ি ফিরছি। বাড়ি ফিরে দেখতাম মা সন্ধ্যা পূজা দিচ্ছে, শংখ ফু দিচ্ছে। অনেক দিন মা আমাকে বলত, মনি তুই একটু সন্ধ্যাটা লাগাতো, বৃহঃবার সন্ধ্যা পূজার সাথে লক্ষি পূজা হত। কলা আর বাতাসা দিয়ে। আমি বাজার থেকে কলা আর বাতাসা এনে দিতাম কিংবা বাবা নিয়ে আসত। মার ভেতর একটা অস্থিরতা দেখতাম কলা বাতাসা আনতে দেরি হলে। পুজার শেষ হলে , কিছু সময় দিতাম ঠাকুরকে খাওয়ার জন্য। হ্যাঁ তখন বিশ্বাসটা এই রকম ছিল, পূজার পর ভগবান ঐ কলা বাতাসা খাবে, কিন্তু দেখ যেত কিছু কালো পিঁপড়া এসে খাওয়া শুরু করেছে। আমি আর দিদি মনে করতাম কালো পিঁপড়াদের ভগবান পাঠিয়ে দেয়। আমি মনের ভেতর এখনো সেই ছোট বেলার সত্ত্বাকে খুঁজে পাই, কি নিষ্পাস ছিল চিন্তা ভাবনা কিংবা দিন গুলো।