বাংলা প্রবাদে বলা হয় – “বারো মাসে তেরো পার্বণ”। অর্থাৎ বাঙালি জীবনে আনন্দ-উৎসবের কোনো অভাব নেই; প্রায় প্রতিটি মাসেই কোনো না কোনো ধর্মীয় বা সামাজিক উৎসব থাকে। এই উৎসবগুলি মূলত হিন্দু ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান, আবার গ্রামীণ সমাজে কৃষি-সংস্কৃতির সাথেও যুক্ত।
চলুন মাসভিত্তিক কিছু প্রধান উৎসব ও পার্বণ সাজিয়ে দেখি—
১. বৈশাখ
পয়লা বৈশাখ (নববর্ষ) – বাংলা বছরের প্রথম দিন, ব্যবসায়ীদের ‘হালখাতা’, মেলা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান।
গাজনের মেলা – শিব ও ধর্মঠাকুরকে ঘিরে সন্ন্যাসী ও ভক্তদের নানা ব্রত, গানের আসর।
২. জ্যৈষ্ঠ
মনসা পূজা (বিশেষ অঞ্চলে শুরু) – সাপদেবীর আরাধনা।
রথযাত্রা – জগন্নাথদেবের রথযাত্রা উৎসব, মেলা বসে।
৩. আষাঢ়
রথযাত্রা মহোৎসবের সমাপ্তি (উল্টো রথ)।
বর্ষা সংক্রান্তি – কৃষিনির্ভর অঞ্চলে বিশেষভাবে পালিত।
৪. শ্রাবণ
শ্রাবণী শিবরাত্রি – ভক্তরা শিবপূজা করেন, কাশী থেকে জল এনে শিবলিঙ্গে অর্পণ।
ঝুলন যাত্রা – কৃষ্ণ-রাধার দোল উৎসব।
৫. ভাদ্র
কৃষ্ণজন্মাষ্টমী – ভগবান শ্রীকৃষ্ণের জন্মোৎসব।
বামন অবতারের পূজা (বিশ্বকর্মা পূজা কাছাকাছি সময়ে)।
বিশ্বকর্মা পূজা – কারখানা, অফিস, দোকান ও কারিগররা পালন করেন।
৬. আশ্বিন
দুর্গাপূজা – বাঙালির প্রধানতম উৎসব; ষষ্ঠী থেকে দশমী পর্যন্ত মহোৎসব।
লক্ষ্মী পূজা – দুর্গাপূজার পরপরই কুমারী পূজার সঙ্গে জড়িয়ে গ্রামীণ উৎসব।
৭. কার্তিক
কালীপূজা ও দীপাবলি – মা কালীকে আরাধনা, প্রদীপ প্রজ্বলন।
ভাইফোঁটা – দিদি-বোনেরা ভাইয়ের কপালে ফোঁটা দেন।
জগদ্ধাত্রী পূজা – বিশেষত চন্দননগরে বিখ্যাত।
৮. অগ্রহায়ণ
নবন্ন উৎসব – নতুন ধান কাটার আনন্দ-উৎসব।
জগদ্ধাত্রী পূজা (কোথাও চলতে থাকে)।
৯. পৌষ
পৌষ সংক্রান্তি / পৌষসংক্রান্তির মেলা – শীতের পিঠে-পুলি উৎসব।
সীতার অন্নকূট পূজা – কৃষিজীবী সমাজে পালিত।
১০. মাঘ
সরস্বতী পূজা – বিদ্যার দেবীর পূজা, স্কুল-কলেজে বড় উৎসব।
মাঘী পূর্ণিমা স্নান – গঙ্গাস্নান, তীর্থযাত্রা।
১১. ফাল্গুন
দোলযাত্রা ও হোলি – আবির খেলায় রঙের উৎসব, কৃষ্ণ-রাধার দোল।
শিবরাত্রি – মহাদেবের আরাধনা।
১২. চৈত্র
চৈত্র সংক্রান্তি – বছরের শেষ দিন; মেলা, গাজন, চড়ক পূজা।
গাজনের পূজা – সন্ন্যাসী ভক্তদের দেহযন্ত্রণা, নৃত্যগান, শোভাযাত্রা।
“তেরো পার্বণ” কথাটির মানে
এই তালিকায় আমরা দেখছি, প্রায় প্রতিটি মাসেই অন্তত একটি বড় উৎসব থাকে। কিছু মাসে তো একাধিক পার্বণ লেগেই আছে। তাই বারো মাসে তেরো পার্বণ— অর্থাৎ বাঙালির ক্যালেন্ডারে আনন্দ-উৎসবের কোনো ঘাটতি নেই। আসলে কৃষিজীবী সমাজে খামার, ঋতু, ফসল কাটার সাথে সাথে ধর্মীয় ও সামাজিক অনুষ্ঠান মিলে জীবনকে করেছে রঙিন।
এভাবে এক বছরের এই উৎসব চক্র বাঙালি সমাজে জীবনের তাল-লয়ের মতো ঘুরে ঘুরে আসে। চাইলে আমি প্রতিটি উৎসবের পেছনের পুরাণ-ঐতিহাসিক কাহিনি আর লোকজ রীতির বিবরণও সাজিয়ে দিতে পারি, যাতে বোঝা যায় কেন এসব পার্বণ জন্ম নিয়েছিল।