এ এক গভীর, রক্তিম, এবং রহস্যে জড়ানো কাহিনি—মা কালীর। দেবী কালী কেবল এক দেবতা নন; তিনি সময়ের (কাল) স্বরূপ, সৃষ্টি ও বিনাশের মধ্যবর্তী অন্ধকারের প্রতিমা। তাঁর নাম “কালী” এসেছে “কাল” শব্দ থেকে—যার মানে সময়, মৃত্যু, রূপান্তর। সেই জন্যই তিনি “মা শ্যামা”, যিনি একাধারে ভয়ংকর আর মমতাময়ী।
🌑 জন্ম ও পরিচয়
দেবী কালীর প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায় দেবী মহাত্ম্যম বা চণ্ডী গ্রন্থে, যা মার্কণ্ডেয় পুরাণ–এর অংশ।
গল্পটি শুরু হয় তখন, যখন অসুরদের হাতে দেবতারা পরাজিত। মহামায়া দুর্গা তখন বিভিন্ন রূপে প্রকাশিত হন অসুরনিধনের জন্য। এক পর্যায়ে তিনি নিজের ভ্রূকুটি থেকে ক্রোধে এক কালো, ভয়ংকর রূপ ধারণ করেন—সেই রূপই কালী। তাঁর চোখ লাল, চুল ছড়ানো, গলায় খুলি-মালা, হাতে তলোয়ার আর কাটা মুণ্ডু। তিনি যুদ্ধক্ষেত্রে অসুরদের রক্ত পান করেন, যাতে সেই রক্ত মাটিতে পড়ে নতুন অসুর না জন্ম নিতে পারে।
⚔️ অসুর বধের কাহিনি
সবচেয়ে পরিচিত গল্পটি হল রক্তবীজ বধ। রক্তবীজের শরীরের প্রতিটি ফোঁটা রক্ত থেকে নতুন রক্তবীজ জন্ম নিত। তাই মা দুর্গার সেনা যতই তাকে আঘাত করে, সে ততই বাড়ে। তখন দুর্গা নিজের ভ্রূকুটি থেকে কালীকে প্রকাশ করেন। কালী মাটিতে ছড়ানো রক্ত জিহ্বা দিয়ে চেটে নেন—যাতে নতুন কোনো রক্তবীজ জন্ম না নিতে পারে। সেইভাবে অসুরবিনাশ সম্পূর্ণ হয়।
💀 শিবের সঙ্গে দেখা — “মহাকাল ও মহাকালী”-র মুহূর্ত
অসুরবধ শেষে কালী উন্মত্ত রূপে নৃত্য শুরু করেন—এমন নৃত্য, যা মহাবিনাশ ডেকে আনতে পারে। দেবতারা ভীত। তখন ভগবান শিব সামনে আসেন। তিনি কালীকে থামাতে নিজের দেহ তাঁর পথের ওপর ফেলেন। মা কালী যখন শিবের বুকে পা রাখেন, তখন তাঁর মধ্যে হঠাৎ চেতনা ফিরে আসে—তিনি বুঝতে পারেন তিনি নিজের স্বামী মহাদেবের ওপর পা রেখেছেন।
এই ঘটনার মুহূর্তেই কালী লজ্জিত হয়ে জিহ্বা বের করেন—যা আজও তাঁর প্রতিমায় চিহ্নিত।
এই দৃশ্য প্রতীকী—বিনাশের শক্তিকে সৃষ্টির শক্তি শিবের উপস্থিতি থামিয়ে দেয়। অর্থাৎ, ধ্বংসও এক পর্যায়ে শিবতত্ত্বে মিশে শান্ত হয়ে যায়।
🌺 তারপর কী হয়?
এই ঘটনার পরে বলা হয়, মা কালী শ্যামা রূপে শান্ত হন।
তাঁর এই রূপই “শ্যামা মা” — গা শ্যামবর্ণ, মুখে মাতৃত্বের কোমলতা।
অতএব, কালী পূজাকে অনেকেই বলেন শ্যামা পূজা — অর্থাৎ সেই কালী যিনি শান্ত, মমতাময়ী, গৃহিণীস্বরূপ।
এই কারণেই বাংলায় দীপাবলির রাতে হয় শ্যামা পূজা—যেখানে অন্ধকারে আলোর প্রদীপ জ্বালিয়ে মানুষ নিজের ভেতরের অজ্ঞান ও ভয় দূর করতে চায়।
🕉️ তাত্ত্বিক অর্থে
মা কালী সময়ের (কাল) দেবী।
তিনি জানান দেন—সব সৃষ্টি ধ্বংস হবে, আবার ধ্বংস থেকেই নতুন সৃষ্টি জন্ম নেবে।
তাঁর রূপ ভয়ংকর, কিন্তু তা ভয় দেখানোর জন্য নয়—ভয়কে অতিক্রম করার শিক্ষা দেওয়ার জন্য।
তাঁর গলায় খুলি-মালা—সময় ও মৃত্যুর প্রতীক।
তাঁর নগ্নতা—প্রকৃতির নিরাবরণ সত্য।
তাঁর নাচ—সৃষ্টির ও বিনাশের চক্র।
আর তাঁর জিহ্বা—আত্মবোধের মুহূর্ত।
🌌 শেষে কোথায় গেলেন?
পুরাণ অনুযায়ী, শিবের বুকে পা দেওয়ার পর কালী নিজেকে সংযত করেন এবং হিমালয় বা শ্মশানে তপস্যায় লীন হন। অনেক স্থানে বলা হয়, তিনি আবার দুর্গার অন্তরে মিশে যান—কারণ কালী মূলত দুর্গারই এক রূপ।
তাঁর এই তপস্যার রূপেই কালী পরবর্তীতে শ্যামা, ভদ্রকালী, অন্নপূর্ণা, এমনকি তারা মা হিসেবেও পূজিতা হন।
মা কালী তাই কেবল দেবী নন—তিনি সময়, মৃত্যু, মা, রাগ, করুণা—সব কিছুর মিলনবিন্দু।
তিনি আমাদের শেখান: অন্ধকারকে ভয় না করে, তাকে জানো; কারণ সেখানেই আলো জন্ম নেয়।
🌑 রক্ষাকালী, ভদ্রকালী, চণ্ডীকালী ইত্যাদি রূপের উৎপত্তি
কালী আসলে একাধিক রূপে পূজিতা—
রক্ষাকালী, ভদ্রকালী, চণ্ডীকালী, শ্মশানকালী, গুহ্যকালী, দাক্ষিণ্যকালী—এইসব রূপের পেছনে রয়েছে সময় ও সমাজভেদে ভক্তির বিবর্তন।
রক্ষাকালী – গ্রাম ও পরিবারের রক্ষাকারী দেবী। বাংলার গ্রাম অঞ্চলে রক্ষাকালী পুজো মানে প্রায় “গ্রামদেবতা”র রূপে কালী। এখানে তাঁর রূপ মাতৃত্বপূর্ণ—গ্রামের মানুষ বিশ্বাস করে, তিনি তাদের রোগ, শত্রু ও দুর্ভিক্ষ থেকে রক্ষা করেন।
ভদ্রকালী – এই রূপ তুলনামূলক শান্ত, স্নিগ্ধ। “ভদ্র” মানে শুভ বা মঙ্গল। তাঁর পূজা সাধারণত অন্নপূর্ণা বা গৃহলক্ষ্মীসুলভ রূপে করা হয়। লোকবিশ্বাসে ভদ্রকালী মানে সেই কালী যিনি রক্তপান নয়, বরং আশীর্বাদ দান করেন।
চণ্ডীকালী – চণ্ডী বা দুর্গারই এক উগ্র রূপ, যেখানে কালী তেজস্বিনী, যুদ্ধপ্রবণ, কিন্তু তবু মায়েরই প্রতীক। চণ্ডীকালী পূজা সাধারণত মহাশ্মশান বা তান্ত্রিক সাধনায় দেখা যায়।
এই সব রূপ তৈরি হয় সময়ের সঙ্গে—স্থানীয় বিশ্বাস, আর্য ও অনার্য উপাসনা, এবং তন্ত্রসাধনার প্রভাবে।
🪶 কালী কি অনার্যদের দেবতা?
এই প্রশ্নটা ঐতিহাসিকভাবে অত্যন্ত আকর্ষণীয়।
হ্যাঁ—অনেক ইতিহাসবিদ ও নৃবিজ্ঞানী মনে করেন, কালী মূলত অনার্য বা প্রাক-আর্য সমাজের দেবী।
তাঁকে আর্যরা প্রথমে “ভয়ংকর ও অমঙ্গলজনক” শক্তি বলে দেখেছিল, কিন্তু পরে ধীরে ধীরে তন্ত্র ও শক্তি উপাসনার মাধ্যমে তাঁকে সামাজিকভাবে অন্তর্ভুক্ত করে নেয়।
এই প্রক্রিয়াকে বলে সাংস্কৃতিক সংমিশ্রণ (syncretism)।
যেমন, আর্য ধর্মে পূর্বে পূজিত হতো দিব্যশক্তি পুরুষ রূপে (ইন্দ্র, অগ্নি, বরুণ)। অনার্য সমাজে ছিল মাতৃদেবীর পূজা, প্রকৃতি ও মৃত্যু-জীবনের চক্রের সঙ্গে জড়িত এক আদিম বিশ্বাস। সেই বিশ্বাস থেকেই কালী, মনসা, শীতলা, চণ্ডী প্রভৃতি দেবীদের উৎস।
তাই বলা চলে—কালী মূলত অনার্য উৎসের মাতৃদেবী, যাঁকে পরে আর্য পুরাণে দুর্গা বা পার্বতীর রূপ হিসেবে স্থান দেওয়া হয়।
⚔️ মা দুর্গা ও মহিষাসুর যুদ্ধের সময় কালির আবির্ভাব
এটা দেবী মহাত্ম্যম–এর এক অন্যতম মুহূর্ত।
মহিষাসুর বধের সময় দুর্গার জন্ম হয় দেবতাদের সম্মিলিত শক্তি থেকে—ব্রহ্মা, বিষ্ণু, মহেশ প্রমুখের শক্তির রূপে।
তিনি তখন দশভূজা দুর্গা, মহিষাসুরমর্দিনী।
কিন্তু যুদ্ধ চলার সময় অসুরদের সংখ্যা ও শক্তি বাড়তে থাকে—বিশেষত যখন চণ্ড ও মুণ্ড, রক্তবীজ প্রভৃতি ভয়ংকর অসুরেরা আসে, তখন দুর্গার ক্রোধ থেকে প্রকাশিত হয় কালী।
অর্থাৎ, দুর্গা তাঁর ভেতরকার উগ্রশক্তিকে প্রকাশ করেন কালী হিসেবে।
যেমন কেউ রাগে চোখে আগুন ধরে, তেমনি দেবীর মধ্যে উগ্রতা রূপ নেয় কালো অগ্নিশিখায়—সেই আগুনই কালী।
এইভাবে, কালী আসলে দুর্গার ভেতরের অসীম শক্তির প্রতিফলন—রূপান্তরিত রাগ, বিনাশ, আর ভয়হীনতার প্রতীক।
🔥 প্রতীকী অর্থে
দুর্গা মানে সৃষ্টি ও সংরক্ষণশক্তি, কালী মানে বিনাশ ও সময়ের শক্তি।
দুজন আলাদা নন—একই শক্তির দুই প্রান্ত।
দুর্গা মহিষাসুরকে হত্যা করে অসুরতার অহং দমন করেন।
কালী রক্তবীজকে হত্যা করে অসীম বৃদ্ধি ও বিকারের ভয় দমন করেন।
দুর্গা “রূপ”, কালী “অরূপ”—দুর্গা সমাজের দেবী, কালী সময়ের দেবী।
🌺 ঐতিহাসিকভাবে
বাংলা ও পূর্ব ভারতের মানুষ কালীকে সবচেয়ে ঘনিষ্ঠভাবে গ্রহণ করেছে।
অনার্য, দ্রাবিড়, অস্ট্রিক ও মুণ্ডা জাতিগোষ্ঠীর মাতৃসংস্কৃতি থেকেই এসেছে এই মায়ের ধারণা—যিনি ভয়ংকর হলেও রক্ষাকারী।
তাই “রক্ষাকালী”, “গ্রামকালী”, “ভদ্রকালী”—এই নামগুলো মূলত লোকজ সংস্কৃতির সঙ্গে কালীকে যুক্ত করেছে।
কালী তাই কেবল পুরাণের চরিত্র নয়, বরং ভারতীয় মানসের “অন্ধকারে আলো খোঁজার প্রতীক”।
তিনি সমাজের ভেতর থেকে উঠে আসা শক্তি, যাকে আর্য ধর্ম পরে মহাকাব্যিক মর্যাদা দেয়।
Need to build a Website or Application?
Since 2011, Codeboxr has been transforming client visions into powerful, user-friendly web experiences. We specialize in building bespoke web applications that drive growth and engagement.
Our deep expertise in modern technologies like Laravel and Flutter allows us to create robust, scalable solutions from the ground up. As WordPress veterans, we also excel at crafting high-performance websites and developing advanced custom plugins that extend functionality perfectly to your needs.
Let’s build the advanced web solution your business demands.