আমাদের দেশে এখন প্রায় প্রতি বছর (বন্যা না হলে) ধান, পাট ইত্যাদি ফসলে বাম্পার(যদিও এইটা রাজনৈতিক শব্দ, তবে ফলন যে খুব ভালো হচ্ছে তা নিয়ে সন্দেহ নাই) ফলন হচ্ছে কিন্তু কৃষক তার উৎপাদিত ফসলের দাম পাচ্ছে না। স্বভাবত আগের থেকে উৎপাদন মূল্য অনেকে বেড়েছে যেমন সার, বীজ, জন(শ্রমিক, প্রান্তিক কৃষক নিজেও জমিতে কাজ করে আর সেই সাথে অন্যদের দিয়েও কাজ করায়) ইত্যাদির দাম/মূল্য অনেক বেড়ে গেছে। বাই দ্য ওয়ে, এখানে আমি শুধু ধান চাষের বিষয় নিয়ে লিখছি। আর এই লেখার আইডিয়া মূলত আমার বাড়ি আসার পর থেকেই মাথায় ঘুরছে। তো আবার ফিরে আসি আগের টপিকে। সব কিছু দাম বেড়ে যাওয়ায় কৃষকের উৎপাদন মূল্য অনেক বেড়ে গেছে আর শেষের দিকে ধানের দাম আশানুরূপ থাকে না যা তাদের উৎপাদন মূল্যের অনেক নীচে থাকে বেশির ভাগ সময়। আমার প্রশ্ন হচ্ছে কেন কৃষক ধানের দাম পাচ্ছে না ? আবার যদি চিন্তা করেন এদেশে চালের দাম দিন দিন বেড়ে যাচ্ছে, চালের দাম কমে খুব কম আর সেই তুলনায় প্রতিবছর বেড়ে যাওয়ার রেট অনেক বেশি। যদিও এই প্রভাবটা পড়ছে ধান উৎপাদন খরচ বেড়ে যাওয়াতে। হয়তো এই কারণেই অনেকেই এখন বাদ দাদার পেশা বাদ দিয়ে শহরে গিয়ে রিক্সা চালাচ্ছে। কারণ উপায় নাই।
এখন আমার চিন্তাটা বা আইডিয়া হচ্ছে কিভাবে কিভাবে কৃষক ধানের দাম চালের মতই বেশি পেতে পারে। তার আগে একটু অন্য ভাবে। আমি নড়াইল আসার পর থেকে আমার বাবা আমাকে কয়েকবার বলেছে একটা জমির সন্ধান পাওয়া গেছে যেখানে কৃষককে ‘x’ পরিমান টাকা দিলে জমিটা সে আমাদের কাছে বন্ধক রাখবে আর আমরা ফসলে Y% ভাগ পাব। যদিও আমি রাজি হইনি কিন্তু কেন কৃষকের জমি বন্ধক রেখে টাকা নিতে হবে আর চাষ করার পর সে কেন জমির জামিনদারকে নিজের কষ্টে উৎপাদিত ফসলের ভাগ দিবে যেখানে সে নিজেই তার ফসলের সঠিক উৎপাদিত মূল্য পাচ্ছে না। সব কিছুর সাথে জড়িত অর্থ বা টাকা। এদেশের বেশির ভাগ কৃষকের হয় অনেক জমি আছে না হয় সামান্য কিংবা অন্যের জমি বর্গা নিয়ে চাষ করে। যাদের অনেক জমি আছে তাদের হাত প্রয়োজনীয় অর্থ নাই যা দিয়ে তারা চাষ করবে। আবার চাষ করার পরই চিন্তা আসে কিভাবে ধান বিক্রি করে দ্রুত খরচের টাকা তুলে আনা যায়। ব্যাপারটা কিন্তু সেই স্বল্প পূঁজির শেয়ার বাজারের ব্যবসায়ীদের জন্যও প্রযোজ্য। যদি শেয়ার এর দাম কমার পরও তারা ছয় মাস থেকে এক বছর অপেক্ষা করতে পারে তাহলে হয় ক্ষতি কমে যাবে কারণ দাম আবার বাড়বে এটা আশা করায় যাই। তবে এই অপেক্ষা করার জন্য দরকার প্রয়োজন খরচের টাকা হাতে থাকা যা স্বল্প পূঁজির একজন শেয়ার ব্যবসাযীর কাছে থাকে না তেমন থাকে গ্রামের প্রান্তিক কৃষকের কাছে। বরং প্রতিবছর ফসলের দাম কম পেতে পেতে তার মূলধন কমতে থাকে আবার নিজের পরিবারের খরচ কিন্তু দিনকে দিন বাড়তেই থাকে। যদি কৃষকের হাত টাকা থাকে তাহলে কিন্তু সে সাথে সাথে ধান বিক্রি করবে না। তাহলে ? …
তাহলে যা করা যেতে পারে তা হল কৃষক নিজেই ধান সিদ্ধ করে চাল বানাবে, নিজের মিলেই ধান থেকে চাল তৈরি করবে। এরজন্য দরকার চাতাল (যেখানে ধান শুকানো এবং সিদ্ধ করা হয়) আর ধান ভাঙানো মিল (চালের কল)। তাহলে ধান থেকে চাল তৈরি করে নিজেই গুদামজাত করে আস্তে আস্তে চাল হিসাবে বিক্রি করতে পারবে। আর সেক্ষেত্রে উৎপাদিত ফসলের দাম অনেক পাবে। এটা হচ্ছে একজন কৃষক কিভাবে তার উৎপাদিত ধানের দাম চাল হিসাবে বিক্রি করে বেশি পেতে পারে। কিন্তু মূল সমস্যা কৃষকের হাতে সেই পরিমান টাকা নাই। একা একা সব কিছু করা সম্ভব নয়, মানে ধান মাড়ানো বা কলে ধান থেকে চাল বানাতে অনেক খরচ।
এক্ষেত্রে বেশ কিছু পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে তার কিছু হতে পারে সরকারী এবং কিছু বেসরকারী। উল্লেখ্য যে বেসরকারী উদ্যোগের পেছনে আবার লাভ করার প্রবনতা বেশি থাকে আর সরকারী উদ্যোগ বাস্তবায়ন এবং দূর্নীতির সম্ভবনা বেশি।
সরকারী উদ্যোগঃ সরকারী ভাবে এলাকা ভিত্তিক সিজনাল চাতাল এবং ধান মাড়াই কল থাকতে পারে। এক্ষেত্রে চল এবং চাতালের খরচ সরকার বহন করবে বা সামান্য কিছু ফি প্রতিমন ধান প্রতি কৃষকের কাজ থেকে সরকার পেতে পারে। আবার কৃষক এই সময়ে চাইলে নিজেই ঐ চাতালে কাজ করতে পারেন। হতে পারে কৃষক নিজেই কাজ করলে তার ধান মাড়াই এর জন্য কোন টাকা নেওয়া হবে না। বা এমন হতে কারীগরী সহায়তা দেবে সরকার আর শ্রম দেবে কৃষক।
বেসরকারী উদ্যোগঃ এমন হতে পারে যে পাঁচ গ্রামের কৃষক নিজেরা সমবায় সমিতি করে নিজেরা একটা চাতাল এবং চালের কল দিল এবং নিজেরা সবাই মিলে খরচ দিয়ে উৎপাদিত ধানের রেশিও অনুসারে মোটামুটি ব্যয় বহন করলো। এক্ষেত্রে এই সব চাতালা এবং চালের কলে কৃষক এর পরিবারের সবাই এক সাথে কাজ করতে পারবে। মানে সবাই মিলে গায়ে শ্রম দিলে খরচ কমে যাবে আর এক বার একটা চালের কল কিনলে সেইটা অনেক বছর চালানো যাবে। তবে এই ধরনের উদ্যোগের জন্য সরকারী সাহায্যো প্রয়োজন। গ্রামের মাতব্বর, চেয়ারম্যান এরা চাইলে এই ধরনের উদ্যোগ নিতেই পারে।
আপনার টাকা আছে আপনি চাইলেও এভাবে ধান চাষ করে সেইটা শেষ মেষ চাল হিসাবে বিক্রি করে লাভ করতে পারে। কারণ চালের দাম কখনই কমে না বা মোটামুটি কৃষকের অনুকূলে থাকবে। আমার ইচ্ছা আছে এই ভাবে কিছু একটা করা আগামীতে আর যদি করতে পারি তাহলে আমার বানানো চাতাল এবং চালের কলে নাম মাত্র মূল্যে আমি প্রান্তিক কৃষকদের ধান থেকে চাল বানানোর সুযোগ দেব। হয়তো আরো অনেকে মিলে চিন্তা করলে এই ধরনের সমস্যার আরো ভালো সমাধান পাওয়া সম্ভব।
ধন্যবাদ
এখানে সমবায় পদ্ধতিটাই সবচেয়ে কার্যকর বলে মনে হচ্ছে। কারণ সরকারী উদ্যোগের আশা করা, অরণ্যে রোদন করার সমার্থক। তবে গ্রামের মাতব্বর, চেয়ারম্যানরা এই ধরণের উদ্যোগ নিতে উৎসাহী হবে বলে মনে হয় না। কারণ গ্রামের অধিকাংশ জমি-জমা, ধান মাড়াইয়ের কল এইসব মাতব্বর গোষ্ঠীর দখলে থাকে। কৃষকদের নিজেদের একজোট হয়ে যা করার করতে হবে।
আর আমাদের দেশে ধান সিদ্ধ করার ব্যাপারটা রহিত করা দরকার। চালের অনেক পুষ্টিগুণই এই সিদ্ধকরণ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে বিনষ্ট হয়ে যায়। আমি নিজে সবসময় সিদ্ধ চাল খাওয়ার চেয়ে আতপ চাল খাওয়ার পক্ষপাতি।